prasna bank logo

১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ কেন রদ করা হয়েছিল?

ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতীয় উপমহাদেশের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ইতিহাসে বঙ্গভঙ্গ একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। হিন্দুত্ববাদীদের প্রবল বিরোধিতার মুখে ব্রিটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গ রদ করতে বাধ্য হয়। যার ফলে ঢাকা বাংলা প্রদেশের রাজধানীর মর্যাদা হারায় এবং পুনরায় কলকাতা কেন্দ্রিক রাজনীতি ও অর্থনীতি ব্যবস্থা চালু হয়। ফলে বাংলা প্রদেশের জনগণের মধ্যে ক্রোধ ও অবিশ্বাসের জন্ম দেয়। হিন্দু মুসলিম দুটি সম্প্রদায়ের পারস্পরিক সহ অবস্থানের জায়গায় ফাটল ধরে। বঙ্গভঙ্গ ও এর রদের ফলে বাঙালি বিশেষ করে মুসলমানদের মধ্যে নিজেদের অধিকার ও রাজনৈতিক সচেতনতা তৈরি হয় । যা পরবর্তীকালে স্বাতন্ত্র্য জাতি গঠনে অন্যতম সহায়ক ভূমিকা পালন করে ।

→ বঙ্গভঙ্গ রদের কারণ :

প্রশাসনিক ও রাজনৈতিকসহ বিভিন্ন কারণে ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আইন ঘোষণা করা হলেও ভারতীয় 'জাতীয় কংগ্রেস ও হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদীদের আন্দোলন ও আরো নানাবিধ কারণে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ ঘোষণা করা হয়। নিম্নে বঙ্গভঙ্গ রদের কারণগুলো উল্লেখ করা হলো :

১. সংকীর্ণ হিন্দু জাতীয়তাবাদ : বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাবের প্রথম থেকেই হিন্দুদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার করে। কিন্তু তাদের প্রবল বাধা সত্ত্বেও বঙ্গভঙ্গ ঘোষণা করা হলে তারা এর রদের জন্য ব্রিটিশ সরকারকে চাপ দিতে থাকে এবং এর বিরোধিতা করে। সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে হিন্দু রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক ও সংবাদপত্রের মালিক শ্রেণি বঙ্গভঙ্গের প্রবল বিরোধিতা শুরু করেন। হিন্দু সম্প্রদায় আতঙ্কে ছিল যে, বঙ্গভঙ্গের ফলে অনগ্রসর মুসলিম কৃষক-শ্রমিক সম্প্রদায় শিক্ষা-দীক্ষা ও অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাবে।

২. ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের বিরোধিতা : ১৮৮৫ সালে ভারতীয় জনগণের অধিকার আদায়ের মুখপাত্র হিসাবে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা করা হলেও শুরু থেকে এটি হিন্দুত্ববাদী সংগঠনে রূপ নেয়। মুসলমানদের অধিকার রক্ষায় মোটেই সচল ছিল না। যার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা দেখতে পাই ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের আইন প্রবর্তন হওয়ার পর থেকেই N কংগ্রেস এর চরম বিরোধিতা করতে থাকে। ১৯১১ সালের জুন মাসে সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর নেতৃত্বে বাংলার ১৮টি জেলার র প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব বঙ্গভঙ্গ রদের জন্য ভারতের নতুন বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জের কাছে চরমপত্র দেন। লর্ড হার্ডিঞ্জ এর পরপরই বঙ্গভঙ্গ রদ চূড়ান্ত করেন । 

৩. স্বদেশি আন্দোলন ও সন্ত্রাসী তৎপরতা : বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হওয়ার আগেই হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা বয়কট ও স্বদেশি আন্দোলনের ডাক দেয়। ১৯০৫ সালের ৭ই আগস্ট কংগ্রেস স্বদেশি আন্দোলন ঘোষণা করে। বিলেতি পণ্য-দ্রব্য বয়কটের মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করাই ছিল বয়কট কর্মসূচির উদ্দেশ্য। স্বদেশি আন্দোলনের এক পর্যায়ে ‘গুপ্ত বিপ্লবী সমিতি' গঠনের মাধ্যমে সরকারি কর্মকর্তা, বিচারক, ইংরেজ শাসকদের হত্যার হুমকি প্রদান করা হলে ব্রিটিশ সরকার ভীষণভাবে চিন্তিত হয়ে পড়েন এবং পরে বঙ্গভঙ্গ রদ করে ।

৪. জমিদার ও ব্যবসায়ীদের বিরোধিতা : বঙ্গভঙ্গের ফলে বাংলা নতুন প্রদেশ হওয়ায় অনেক হিন্দু জমিদার বাংলায় তাদের জমিদারিত্ব হারায়। অপরদিকে চট্টগ্রামকে বাংলা প্রদেশের দ্বিতীয় রাজধানী করায় ও বন্দর নগরী হওয়া চট্টগ্রাম কেন্দ্রিক ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটতে থাকে অপরদিকে কলকাতাকেন্দ্রিক ব্যবসা বাণিজ্যে মন্দা দেখা দিলে কলকাতার ব্যবসায়ীরা নিজেদের একচেটিয়া ব্যবসা অক্ষুন্ন রাখতে বঙ্গভঙ্গের চরম বিরোধিতা করে ।

৫. মুসলিম লীগের দুর্বলতা : ১৯০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত মুসলিম লীগ সভা-সমিতির মাধ্যমে বঙ্গভঙ্গকে স্বাগত জানালেও এর সাংগঠনিক কাঠামো তেমন শক্তভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল না। যার ফলে কংগ্রেসের চরম বিরোধিতার জবাবে মুসলিম লীগ কার্যকরী কোনো ভূমিকা পালন করতে পারেনি। যার ফলে ব্রিটিশ সরকার কংগ্রেস নেতাদের দাবির মুখে বঙ্গভঙ্গ রদ ঘোষণা করে ।

৬. বঙ্গভঙ্গের প্রতিক্রিয়া : বঙ্গভঙ্গের ফলে ভারতীয় উপমহাদেশে বাঙালি মুসলিমদের উন্নতি সাধিত হওয়ায় তারা খুশি হয়। পক্ষান্তরে রদ করার ফলে হিন্দুরা খুশি হয়।

পরিশেষে বলা যায়, ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক ঘোষিত বঙ্গভঙ্গ মুসলমানদের জন্য ভাগ্যোন্নয়নের দ্বার উন্মোচিত করেছিল। কিন্তু কায়েমী স্বার্থবাদী হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের চরম বিরোধিতায় তা স্থায়ী হয়নি। হিন্দুদের প্রবল বিরোধিতার মুখে ব্রিটিশ সরকার ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর বঙ্গভঙ্গ রদ ঘোষণা করে। যা অত্র অঞ্চলের হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে ফাটল সৃষ্টি করে এর চরম সাম্প্রদায়িকতার জন্ম হয়। সর্বোপরি ভারতে ব্রিটিশ শাসন আরো দীর্ঘস্থায়ী রূপ নেয় ।

magnifiercross linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram